Ads Area

রামকিঙ্কর বেইজ । অভিনব শিল্পরূপের উদ্ভাবক (লেখক- মনসিজ মজুমদার)


Ramkinkar baij রামকিঙ্কর বেজ



রামকিঙ্কর বেইজ । অভিনব শিল্পরূপের উদ্ভাবক

লেখক- মনসিজ মজুমদার



ভারতীয় কলা ইতিহাসে প্রথম আধুনিকতাবাদী শিল্পী রবীন্দ্রনাথ। তাঁর পরেই রামকিঙ্কর। তিনিই প্রথম আধুনিক ও আধুনিকতাবাদী ভাস্কর। রামকিঙ্কর কলাসাধনা, জীবনচর্চা, ব্যক্তিত্ব, তাঁর ছবি, ভাস্কর্য সব কিছুই এমনই ব্যতিক্রমী যে, তিনি জীবদ্দশাতেই প্রবাদে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি সংঘে সমষ্টিতে একলা, একা শিল্পী, যাঁকে সমাজ-সংসারের কোনও তুচ্ছতা, জীবনের কোনও মালিন্য স্পর্শ করতে পারেনি।

রামকিঙ্করের মত এত বড় মাপের শিল্পীর জীবন ও শিল্পকৃতি নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই আজও  লেখা হয়নি, পরিতোষ সেন একবার দুঃখ করেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে বই, মোনোগ্রাফ, প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণা, শিল্পীর নিজের ভাষায় তাঁর জীবন, সৃষ্টিকাজ, কলাভাবনা সংক্রান্ত নানা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। আলোচ্য বইটি একটি প্রবন্ধ সংগ্রহ মাত্র। এগারোটি প্রবন্ধের সাতটি বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত। রামকিঙ্করের ভাস্কর্য যে মুখ্য বিষয়, তা বইয়ের নামেই সুস্পষ্ট, তবু কমবেশি সব প্রবন্ধেই আছে রামকিঙ্করের শিল্পী জীবন, প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব ও শিল্পকৃতির বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন। বিশেষ-বিশেষ দিক নিয়ে লিখেছেন পরিতোষ সেন, গণেশ পাইন, শিবকুমার, বিপিন গোস্বামী ও জনকঝংকার নার্জারি। সাধারণভাবে তথ্য সমেত মূল্যায়ন করেছেন সম্পাদক নিজের প্রবন্ধে। সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবন্ধে রামকিঙ্করের এক প্রাণবন্ত প্রতিকৃতি পাওয়া যাবে।


চিন্তামণি কর তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম দ্য ওরিজিনেটর অফ আ নভেল আর্ট ফর্ম’—রামকিঙ্করকে অভিনব শিল্পরূপের উদ্ভাবক বলেছেন। এমন দাবি কেউ করেননি। লেখকের আলোচ্য অবশ্য শিল্পীর সেই অলোকসামান্য মৌলিক প্রতিভা যার জোরে রামকিঙ্কর প্রচল ও প্রথা ভেঙে নতুন ও নিজস্ব শৈলীতে ভাস্কর্য সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। প্রথা ভাঙার আর-এক দিক উল্লেখ করেছেন পরিতোষ সেন। যখন শান্তিনিকেতনে এক ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার পরিবেশ ছিল সে-সময় রামকিঙ্কর পেরেছিলেন নর নারীর শরীরী রূপ ও যৌন ব্যঞ্জনাঋদ্ধ মূর্তি গড়তে বা ছবি আঁকতে। আরও মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকলে তাঁর শিল্পসৃষ্টিতে দেখা যেত আরও জোরালো যৌনব্যঞ্জনার প্রাণময় প্রতিমা। অন্যত্র এক প্রবন্ধে কে জি সুব্রহ্মণ্যমও রামকিঙ্করের ছবিতে আঁটোসাঁটো যৌবনদীপ্ত নারীদের কথা বলেছেন, কিন্তু তাঁর মতে এই যৌবনদীপ্ততা...সেক্স সিম্বলকে তুলে না ধরে...তাঁদের শারীরিক উর্বরতাকেই মেলে ধরে।

আলোচ্য প্রবন্ধে রামকিঙ্করকে লেখক বলেছেন ক্ষ্যাপা বাউল, ক্রেজি উইথ আর্ট', মাটি-ঘনিষ্ঠ মানুষ, মিস্টিক। তাঁর কাজে নোনা মাটির সঙ্গে মিশে আছে এক দার্শনিক চেতনা...তাঁর চিত্রকল্পে থাকে একই সঙ্গে দেহব্যঞ্জনার তাৎক্ষণিক আবেদন আর দূরতর কোন প্রাচীন কলা ঐতিহ্য। এই ধরনের পরস্পরবিরোধী ব্যঞ্জনার সমন্বয় ঘটে রামকিঙ্করের কিউবিস্ট পর্যায়ের ছবি ও ভাস্কর্য। ফলে তাঁর কিউবিস্ট শৈলী নিছক অলঙ্কারধর্মী আঙ্গিকসর্বস্ব নয়। কিউবিস্ট নিসর্গ দৃশ্যে প্রকৃতি অটুট থাকে বা কিউবিস্ট প্রতিকৃতিতে ব্যক্তি পরিচিতি বিলীন হয় না। প্রশ্ন উঠতে পারে, পিকাসোর কিউবিস্ট প্রতিকৃতিভোলার বা কাহনভাইলার--কি নিছক আঙ্গিকসর্বস্ব? সদুত্তর পাওয়া যাবে আর শিবকুমারের প্রবন্ধে রামকিঙ্করের বিনোদিনী ও অন্যান্য প্রতিকৃতি নিয়ে আলোচনায়। আমার মতে, এটিই গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ রচনা।

হুবহু বাইরের রূপ আধুনিক প্রতিকৃতির বিষয় নয়। রামকিঙ্করের প্রতিকৃতিতে কিউবিস্ট, এক্সপ্রেশনিস্ট বা সুররিয়ালিস্ট--সাদৃশ্যের চেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে কখনও নরনারীর অন্তঃসত্তা; বাইরের চেহারা পেয়েছে বিমূর্ত অভিব্যক্তি; অন্তর্গূঢ় মানস রূপ ধরা দিয়েছে ভাঙাগড়ার আঙ্গিকে মুখের বিকৃতিতে; কখনও বা মডেলের সম্বন্ধে শিল্পীমনের অন্তরময় অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতা-প্রবাহের একটি ঘূর্ণাবর্তই রামকিঙ্করের গড়া বা আঁকা প্রতিকৃতি।। নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে শিবকুমার মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন, বিশেষ করে রামকিঙ্করের নারী-প্রতিকৃতি নিয়ে, কী ছবিতে কী ভাস্কর্যে। দুঃখের বিষয়, দৃষ্টান্তের ছবির অধিকাংশই নেই বইতে, আর বিনোদিনীর স্টাডির চারটির মধ্যে ছাপা হয়েছে-- একটি দুবার সমেত--তিনটি।

রামকিঙ্করের কলাভাবনা শান্তিনিকেতনের কলাদর্শের বিরোধী ছিল বলে নন্দলালের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল, এমন এক অমূলক ধারণার প্রতিবাদে লেখা প্রভাস সেনের প্রবন্ধ। নন্দলাল যে রামকিঙ্করের প্রতিভামুগ্ধ মাস্টারমশাই ছিলেন, ছাত্রের সবরকম কাজে প্রেরণা দিয়েছেন সেকথা রামকিঙ্কর নিজেই বলেছেন নানা স্মৃতিচারণায়। কিন্তু অনেকের চোখে তাঁর আধুনিকতা বা তাঁর ছবিতে ভাস্কর্য নগ্নদেহব্যঞ্জনা পছন্দের ছিল না। সুনীল পাল তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, তাঁর তথাকথিত আধুনিক শিল্পকৃতি আমার মনে আদৌ দাগ কাটেনি। যদিও তিনি রামকিঙ্কর ভাস্কর্যে ভারতীয় ধ্রুপদি ঐতিহ্যের নিবিড় সম্বন্ধ দেখতে পেয়েছেন, খর রুদ্র অমসৃণ পরুষশক্তিতে প্রাণিত রামকিঙ্করের ভাস্কর্যে মিশেছে লোকশিল্পের সারল্য আদিম শিল্পের নির্মমতা আর আধুনিকতার রহস্য।' কিন্তু লোক ও আদিম শিল্পের অনিবার্য উপাদানেই চিহ্নিত রামকিঙ্করের তথাকথিত আধুনিকতা

বিপিন গোস্বামী রামকিঙ্করের সৃজন-প্রকরণ, শৈলী ও ভাস্কর্যগুলি নিয়ে বিশ্লেষণী আলোচনা করেছেন। রামকিঙ্করের কাজের ধরনের বৈশিষ্ট্যের কথাও বলেছেন। তিনি বারবার ভাঙতেন আর গড়তেন, যতক্ষণ না অন্বিষ্ট রূপের সন্ধান পেতেন। জনকঝংকার নার্জারি তাঁর ভাস্কর্যের শৈলী ও সাংগঠনিক চরিত্র বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেছেন। বিভিন্ন শৈলীতে কাজ করলেও রামকিঙ্করের কাজে ছিল জোরালো  ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, উপচে-পড়া প্রাণশক্তি এবং আবেগ প্রাচুর্য। কিন্তু তাঁর মেধা ও মনন প্রকাশ পেয়েছে তাঁর মূর্তির গড়ন ও সংগঠনের পদ্ধতি ও প্রকরণে। ভাস্কর্যের কোমল আয়তনিক অবয়ব হাতে গড়ার সঙ্গে ছুরি দিয়ে কেটে কেটে সৃষ্টি করতেন তীক্ষ্ণ কৌণিক তল ও অবয়বী রেখা।...রূপময় জগতের দুটি মৌল ধারণা থেকে রামকিঙ্কর নিজস্ব ভাষা গড়ে তুলেছিলেন--দৃশ্যে বাস্তবতা ও জ্যামিতিক বিমূর্ততা। অনেক সময় বাস্তবতা থেকে শুরু করে পৌছতেন বিমূর্ততায়, বিমূর্ততা থেকে বাস্তবতায়। এমন সব উজ্জ্বল মন্তব্য রামকিঙ্করের ভাস্কর্য সম্বন্ধে অনেক ভাবনার খোরাক পেয়ে যাই আমরা।

রামকিঙ্করের ছবি সম্পর্কে গণেশ পাইনও একইরকম মন্তব্য করেছেন। যদিও সেসব মন্তব্য কখনও আমাদের ধারণা প্রসারিত করে, আবার কখনও ধূসরিত করে। দ্রুত আঁকা রেখায় জ্যামিতিক নকশা, ক্যালিগ্রাফির প্রয়োগ, একই সঙ্গে ত্রিমাত্রিক ও দ্বিমাত্রিক অবয়ব রচনা সব মিলিয়ে ছবিতে চিত্রবস্তু ও পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তাতে কোনও নির্দিষ্ট শৈলীর সাদৃশ্য থাকে না। এই মন্তব্যের আগেই যে-ছবিগুলির উল্লেখ করেছেন লেখক, তার প্রথমেই আছে কৃষ্ণের জন্ম এবং সে-ছবির সঙ্গে মিলে যাবে উদ্ধৃত মন্তব্য। রামকিঙ্করের এসব ছবিতেই তো কিউবিজমের প্রভাব সুস্পষ্ট। রেখা ও রঙের ব্যবহার সম্পর্কে লেখক অত্যন্ত মৌলিক মন্তব্য করেছেন। রেখা দিয়ে তাঁর ছবির অবয়ব গড়ে ওঠে, অভ্যস্ত ছন্দের বিপর্যয় ঘটিয়ে ছবির সীমিত শূন্য জমিতে জাগিয়ে তোলে ভাবনার বিস্তার। রেখাই ধরে রাখে প্রতিকৃতি, রেখার মদতেই রামকিঙ্করের ছবি অর্জন করে গভীরতা ও গাম্ভীর্য। তুলনায় রঙের ভূমিকা গৌণ। কিন্তু এরই মাঝখানে একটি নিরালম্ব বাক্য পড়লে পাঠক বিচলিত হতে পারেন—‘রামকিঙ্করের সব প্রধান ছবিতে পাওয়া যাবে ওরিয়েন্টাল আর্টের চারিত্রলক্ষণ


হয়তো মূল বাংলা রচনা পড়লে এইসব সুচিন্তিত মন্তব্যের কারণ বোঝা যেত। অনুবাদে-- যা অনেক সময় অতি দুর্বল--প্রবন্ধগুলির অনেকাংশই থেকে যায় দুর্বোধ্য। যামিনী রায় ও অমৃতা শেরগিলের ছবিতে গ্রামজীবন ও লোকশিল্পের ক্রমবিস্তারী প্রভাব সম্পর্কে গণেশ পাইনের মন্তব্য ইংরেজি অনুবাদে দাঁড়িয়েছে, This widespread rusticity' was overrun with difference in technique and pe trilogy'! এমন বিসদৃশ বা অশুদ্ধ ইংরেজি ভূমিকায় ও অন্যত্র সম্পাদকের নজর এড়িয়ে গেছে। সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের আঁকা মলাটে রামকিঙ্করের প্রতিকৃতি খুবই চমৎকার।


---------------------------------------------

গ্রন্থ- রামকিঙ্কর: পায়নিয়র অফ মডার্ন স্কাল্পচার

সম্পাদনা: প্রশান্ত দাঁ

এম সি সরকার, কলকাতা

---------------------------------------------

বইয়ের দেশ

---------------------------------------------

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area