Ads Area

তারাশঙ্করের লেখা পড়ে রবীন্দ্রনাথ কী জানিয়েছিলেন [চিঠি]







রবীন্দ্রনাথ সমকালীন লেখকদের রচনা শুধু পড়তেনই না, বিভিন্ন সময়ে নিজের অনুভূতিও জানাতেন চিঠি লিখে কিংবা সাক্ষাতে। সবসময়ই যে প্রশংসা করতেন তা নয়, মন্দ লাগলেও তা খোলাখুলি জানাতেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় উভয়েরই চিঠি উল্লিখিত হলো।

[রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠি]


১.

[শান্তিনিকেতন থেকে]
লাভপুর, বীরভূম
কল্যাণীয়েষু,

তোমার ছোট গল্পের কতকগুলি আমার বিশেষ ভালো লেগেছে --- দুএকটা আছে কষ্টকল্পিত। তোমার স্থূলদৃষ্টির অপবাদ কে দিয়েছে জানিনে কিন্তু আমার তো মনে হয় তোমার রচনায় সুক্ষ্মস্পর্শ আছে, আর তোমার কলমে বাস্তবতা সত্য হয়েই দেখা দেয় তাতে বাস্তবতার কোমর বাঁধা ভান নেই। গল্প লিখতে বসে গল্প না লেখাটাকেই যাঁরা বাহাদুরি মনে করেন তুমি যে তাঁদের দলে নাম লেখাওনি এতে খুশি হয়েছি। লেখার অকৃত্রিমতাই সবচেয়ে দুরূহ।

ইতি ---
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১২/০৩/৩৭
-------------------------------------------------- 

২. রসকলি গল্প প্রসঙ্গে

[মংপু থেকে]

লাভপুর, বীরভূম
কল্যাণীয়েষু,
তোমার লেখা যতই পড়চি ততই বুঝচি তুমি একজন লিখিয়ে বটে তাতে সন্দেহ নেই। যে সব চরিত্র এঁকেছ তা সজীব হয়ে উঠেছে, তাদের নিয়ে যে খেলা খেলিয়েছ মনের মধ্যে সে ছাপ দিয়ে যায়, রেশ রাখে।
আমার নামে তোমার রসকলি বইটি উৎসর্গ করেছ। খুশি হয়ে গ্রহণ করলুম। বেশি লেখার শক্তি নেই।
ইতি---
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৫ [২৯ মে ১৯৩৮]
 ---------------------------------------------------
৩.

[Uttarayana, Santiniketan থেকে]
কল্যাণীয়েষু,
নিরতিশয় ব্যস্ততাবশত ইতিপূর্বে তোমাকে পত্র দিতে পারিনি। লাভপুর সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশন সর্বতোভাবে সফল হোক আমি কামনা করি।
তোমাদের সম্মেলনের বিজ্ঞাপনপত্র পড়ে জানা গেল এই সম্মেলনে তোমাকে সম্বর্ধনা করে মানপত্র দেওয়া হবে--- শুনে আনন্দিত হয়েছি --- তোমার এই সম্মাননায় দূর থেকে আমারও যোগ রইল।
ইতি---
শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২৭/০১/৩৯
 ---------------------------------------------------

৪. ধাত্রীদেবতা উপন্যাস প্রসঙ্গে

[মংপু থেকে]
শ্রীযুক্ত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
কল্যাণীয়েষু,
গল্প লেখায় তুমি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অগ্রণীদের মধ্যে। তোমার লেখা আমার বিশেষ ভালো লাগে সে কথা তুমি জানো।
আমার সময়ের অভাব, দৃষ্টিশক্তিও দুর্বল, তবু তোমার ধাত্রীদেবতা কৌতূহলের সঙ্গে পড়তে শুরু করেছিলুম। বইয়ের প্রথম অর্দ্ধেক অংশে তোমার হাতের নৈপুণ্য উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু যেখানেই তোমার গল্পের জন্য উচ্চ মঞ্চ গড়ে তুললে সেখানেই সে স্বস্থানচ্যুত স্বভাবভ্রষ্ট হয়ে পড়ল। মনে হল এ অংশটা যেন অনুরূপা দেবীর লেখা। একশ্রেণীর পাঠকদের কাছে তুমি পুরস্কার পাবে কিন্তু সেই পুরস্কার তোমার যোগ্য হবে না। তোমার এই লেখাটিকে পরিমাণে বড় করতে গিয়ে সম্মানে ছোট করেছ আমার এই অভিমত ক্ষোভের সঙ্গে জানাতে হল। তোমার রচনা কে আমি শ্রদ্ধা করি বলেই তোমাকে দুঃখ দিতে আমি দুঃখবোধ করচি।
বিজয়ার আশীর্বাদ গ্রহণ কর।

ইতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিজয়া দশমী ১৩৪৬
২২ অক্টোবর ১৯৩৯
 ----------------------------------------------------

(তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'রাইকমল' গল্প পড়ে রবীন্দ্রনাথ আপ্লুত হয়ে তারাশঙ্করকে চিঠি লিখে তা জানিয়েছিলেন। এবং প্রত্যুত্তরে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ও রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লেখে। এই দুটি চিঠি [রবীন্দ্রনাথের লেখা ৫ নং ও তারাশঙ্করের লেখা চিঠিটি] এখানে তুলে ধরা হলো।)

৫. রাইকমল গল্প প্রসঙ্গে


[শান্তিনিকেতন] 
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়
লাভপুর, বীরভূম
কল্যাণীয়েষু,

আমার বইখানি পড়ে অনুপস্থিত থাকাতে বইখানি আমার হতে এসে পড়েছিল তার পরিতাপের কারণ ঘটেনি৷ রাইকমল গল্পটির রচনায় রস আছে এবং জোর আছে-- তাছাড়া এটি ষোলো আনা গল্প, এতে ভেজাল কিছু নেই ৷ পাত্রদের ভাষায় ও ভঙ্গীতে যে বাস্তবতার পরিচয় পাওয়া গেল সেটি গড়ে তোলা সহজ নয়৷ তোমার অন্য বইটি সময় পেলে পরে পড়ব।

ইতি--
শুভার্থী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২৮মাঘ, ১৩৪৩ (১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৭)
 --------------------------------------------------


[তারাশঙ্করের লেখা চিঠি] 



১. রবীন্দ্রনাথের উল্লিখিত ৫ম চিঠির প্রত্যুত্তরে

[লাভপুর, বীরভূম থেকে]
ওঁ
শ্রীচরণেষু,
আপনার পত্রখানি আশীর্বাদস্বরূপ মাথায় নিয়েছি ৷ 'রাইকমল' অপনার ভালো লেগেছে, সেহেতু নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি৷
পত্রখানি পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে পুনরায় প্রণাম নিবেদন করবার প্রবল বাসনা আমাকে চঞ্চল করে তুলছিল৷ কিন্তু সংবাদপত্রে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাধি বিতরণ সভার নিমন্ত্রণে আপনি কলকাতায় যাবেন৷ তারপর দেখলাম, চন্দননগরে আপনার উপস্থিতির সংবাদ ঘোষিত হয়েছে৷ তারপর দেখলাম ধম্মমহাসম্মেলনে আপনার উপস্থিতির বার্তা! তাই পত্র লিখি নাই, আপনার কর্ম্মমুখর সময়ের মধ্যে আপনাকে আমার কথা স্মরণ করিয়ে দেবার ধৃষ্টতা আমার কাছেই অমার্জ্জনীয় বলে মনে হয়েছিল৷
 গল্প সাহিত্য সম্বন্ধে কিছু জানবার বাসনা করি৷ আজকাল বাংলা সাহিত্যে গল্পের ফুলবনে নানা ফুল ফুটছে৷ কিন্তু অধিকাংশেরই দেখি গল্পের মধ্যে কাঠামোর বর্ণবৈচিত্রের ওপরেই ঝোঁক বেশী। গল্পের মধ্যে কি আখ্যানভাগ থাকবে না?--- মানুষ থাকবে না, থাকবে শুধু মানুষের মনের একটি দীর্ঘ-নিম্বাস, অথবা পুলকিত দৃষ্টির পলক আকাশবিহারী নারদের বীণাবিচ্যুত পারিজাতের আঘাতে ইন্দুমতীর জীবনান্ত হয়েছিল, কিন্তু তার শোকে অজরাজের বিলাপ, বেদনা কি কম মর্ম্মস্পর্শী না, সাহিত্যের আসরে স্থূল বলে তার আদর কম হবে? আমার গল্পের বই ছলনাময়ীর মধ্যে আপনার দৃষ্টি পড়েছে কিনা জানি না। আমার কলম এবং মন স্থূল বলেই নাকি, আমি আখ্যান বৈচিত্র‍্য এবং মানুষের রূপের পক্ষপাতী। এ বিষয়টি সম্বন্ধে আপনার কাছে জানবার বাসনা আছে এবং উত্তর আপনার কাছে প্রার্থনা করি৷ 
আমার প্রণাম গ্রহণ করবেন৷ আপনার নীরোগ প্রসন্ন স্বাস্থ্য ভগবানের চরণে প্রার্থনা করি৷

ইতি--
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪শে ফাল্গুন ১৩৪৩ (৮ মার্চ, ১৯৩৭)



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area